রবিবার, ২৪ জুন, ২০১২

রাজনীতিতে কালো মেঘ


মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম  
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে, দিন দিন দেশের বিস্তৃত রাজনৈতিক গগন কালো মেঘের ঘনঘটায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। চতুর্দিকে বইছে পাগলা হাওয়ার ঘূর্ণি। বাতাসে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। কি হয়, কি হয়,—সবার মনে এমন একটি ভীতির ভাব। অনেকেই বলাবলি করছেন যে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দু’দিনের ‘তাত্পর্যপূর্ণ’ ঢাকা সফরের পর-পরই রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার বদলে তা এভাবে আরো অবনতি হতে শুরু হওয়ার কোনো যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে। তেমন কোনো যোগসূত্র সত্যিই কিছু আছে কি?
দেশের মানুষ আজ দুশ্চিন্তায় পাগল হওয়ার পথে। হঠাত্ করেই তাদের মাথায় দুশ্চিন্তার বোঝা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। অবস্থাটি অনেকটাই শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পরিণীতা’ উপন্যাসের গরিব কেরানী গুরুচরণের পঞ্চম কন্যাসন্তানের জন্ম সংবাদ শোনার পর তার মনের পরিস্থিতির মতো। শরত্বাবুর ভাষায়: ‘ভিড়ের দিনে স্টেশনে গাড়ি আসিলে দোর খোলা পাইলে থার্ড ক্লাসের যাত্রীরা পোঁটলা-পুঁটলি লইয়া পাগলের মতো যেভাবে লোকজনকে দলিত পিষ্ট করিয়া ঝাঁপাইয়া আসিতে থাকে, তেমনি মার-মার শব্দ করিয়া তাহার (গুরুচরণের) মগজের মধ্যে দুশ্চিন্তারাশি হু হু করিয়া ঢুকিতে লাগিল।’ বাংলাদেশের এখন হয়েছে গুরুচরণের মতো অবস্থা। দুশ্চিন্তারাশি প্লাবনের মতো স্বস্তি ও শান্তিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেছে।
পরিস্থিতি আগে থেকেই খারাপ চলছিল। কিন্তু হঠাত্ তা সোজা পাতালমুখী হতে শুরু করেছে। প্রশ্ন হলো: এভাবে পরিস্থিতির এরূপ দ্রুত পাতালমুখী হতে থাকার ঘটনা কি স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিকতার ফসল, নাকি তা নতুন কোনো রাজনৈতিক নাটক মঞ্চায়নের জন্য একটি পরিকল্পিত নীলনকশার অংশ?
বাংলাদেশে এখন আসলে বিরাজ করে পৃথক দু’টি বাংলাদেশ। একটি হলো সুবিধাভোগী, ‘ভাগ্যবান’ ও ক্ষমতাবান ১ শতাংশ দেশবাসীর একটি বাংলাদেশ। অপরদিকে রয়েছে শোষিত, বঞ্চিত, ‘ভাগ্যহীন’ অবশিষ্ট ৯৯ শতাংশের অপর একটি বাংলাদেশ। দেশ বদল হয়, সরকার বদল হয়—কিন্তু ভাগ্যাহত এই ৯৯ শতাংশের ‘ভাগ্য’ বদলায় না। দ্রব্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সম্প্রতি মূল্যস্ফীতি ডাবল ডিজিটের ওপরে উঠে গেছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার আরো বেশি। পরিবহন খরচ, শিক্ষা খরচ, বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুত্-পানি-গ্যাসের রেট ইত্যাদি দু’দিন পরপরই বাড়ানো হচ্ছে। বাজারে, ঘরে-অফিসে, পথে-ঘাটে, সংসার চালাতে এই ৯৯ শতাংশ মানুষের মাথায় নিত্যদিন বজ্রপাত ঘটছে। সংসার খরচ হু হু করে বাড়লেও, সেই তুলনায় আয় বাড়ছে না। তাই অভাব তাদের পিছু ছাড়ছে না। তাদের সবারই অবস্থা আজ হয়ে উঠেছে শরত্বাবুর ‘পরিণীতার’ গুরুচরণের মতোই।
ধরা যাক গার্মেন্টস শ্রমিকদের কথা। সরকার ১০০ দিনের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে দৈনিক মজুরি স্থির করেছে ১৫০/- টাকা। অর্থাত্ মাসে ৪,৫০০/- টাকা। অবশ্য এর বড় অংশ চলে যায় সরকার দলীয় টাউট ও তদবিরবাজদের পকেটে। অথচ গার্মেন্টস শ্রমিকের জন্য নিম্নতম মজুরি নির্ধারিত হয়েছে মাত্র ৩,০০০/- টাকা। তাছাড়া ৩ হাজার টাকা নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের পর ২ বছর পার হয়েছে। ইতোমধ্যে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। তার মানে হলো, শ্রমিকদের প্রকৃত আয় বা ক্রয়ক্ষমতা ৩০ শতাংশ কমেছে। কিভাবে তাহলে চলবে শ্রমিক, কর্মচারী, নির্দিষ্ট আয়ের মানুষরা?
কৃষকরা সবসময়ই বঞ্চিত। কিনতে গেলে দাম বেশি। বেচতে গেলে দাম নেই। এবার তো তাদের মাথায় হাত! ১ মণ ধান উত্পাদনে যেখানে খরচ হয়েছে ৭৫০-৮০০ টাকা, তা এবার তাদেরকে বেচে দিতে হয়েছে ৫০০-৫৫০ টাকায়। নানাভাবে চতুর্দিক থেকে তারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত, বঞ্চিত ও অত্যাচারিত হচ্ছে। প্রবাসে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে আয় করা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে যারা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রেখেছে, তাদের ভালো-মন্দের খোঁজ রাখার দিকে কারোই যেন তেমন কোনো নজর নেই। এদের সংখ্যা প্রায় ৭০-৮০ লাখ। এই সংখ্যা একটি মধ্যমাপের রাষ্ট্রের মোট অধিবাসীর সমান। কিন্তু তাদের দেখভালের জন্য কতটুকু লোকবল ও শক্তি আমাদের রাষ্ট্র থেকে প্রদান করা হয়? অথচ প্রবাসীদের রক্ত-ঘামে অর্জিত এই মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে স্মাগলার, দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক লুটেরার দল। সমাজে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা, ঘুষ-দুর্নীতি, দলবাজি, চাঁদাবাজি, খুন-গুম-হত্যা-রাহাজানি ইত্যাদি। সব যেন ‘মগের মুল্লুক’ হয়ে উঠেছে। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বেড়ে গেছে। ছড়িয়ে পড়েছে মাদকাসক্তি, নারী নির্যাতন, অপহরণ ইত্যাদি। নীতি, নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে ঘটে চলেছে বিপজ্জনক অবক্ষয়।
সমাজ বাস্তবতার এহেন বর্ণনা শেষ হবার নয়। এ ধরনের অবস্থার মাঝেই দেশবাসীকে চলতে হচ্ছে বছর-বছর, দশক-দশক ধরে। এই অবস্থা বদলাতে পারতো সরকার। কিন্তু সেজন্য তাকে রাষ্ট্রব্যবস্থার ও দেশের অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থার আমূল বিপ্লবী পরিবর্তন সাধন করতে হবে। শ্রমজীবী মানুষসহ ৯৯ শতাংশ মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী দল-জোটের সরকার ক্ষমতায় আসতে পারলেই কেবল তেমনটা সম্ভব হতে পারে। ১ শতাংশ লুটেরাদের দল-জোটের সরকার দিয়ে (বুর্জোয়া দল দুটোর মধ্যে কোনোটিকে দিয়েই) সে কাজ হবে না।
এখন প্রশ্ন হলো, অব্যাহত ‘মন্দ’ পরিস্থিতির কথাতো না হয় বুঝলাম। কিন্তু এখন হঠাত্ চারদিক অন্ধকারে ছেয়ে গিয়ে ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডব শুরু হলো কেন? অরাজকতা, নৈরাজ্য, সংঘাত, সংঘর্ষ, অচলাবস্থা ইত্যাদির দিকে ঘটনাবলি একসাথে লাইন করে এভাবে দ্রুত ধাবিত হতে শুরু করেছে কেন? এগুলো কি দেশকে অনিবার্য রাজনৈতিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না? এসব কি জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসার সাথে সাথে গভীর হতে থাকা ‘মওসুমি রাজনৈতিক নিম্নচাপ’, নাকি অন্যকিছু? এক্ষেত্রে ভাবনার বিষয় হলো—এসব ঘটনার ফলে রাজনৈতিক বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠছে, নাকি রাজনৈতিক বিপর্যয়ের নীলনকশা রূপায়ণের লক্ষ্যে এসব ঘটনাকে উস্কে দেয়া হচ্ছে? সবকিছুর মধ্যে একটি অতিপরিচিত ষড়যন্ত্রের ছায়া পরিলক্ষিত হওয়ায় একথা। সন্দেহ করার কারণ আছে যে, মুখে ‘সমঝোতার’ পরামর্শ দিলেও দেশি-বিদেশি একটি বিশেষ মহল ওয়ান-ইলেভেন কায়দার নতুন একটি নীলনকশা বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপট ও পরিস্থিতি তৈরিতে নেমেছে।
সাগর-রুনী সাংবাদিক দম্পতির হত্যাকাণ্ড, এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তকাজ নিয়ে রহস্য-সন্দেহ, ইলিয়াস আলীর গুম হওয়া, রেলমন্ত্রীর এপিএস-এর গাড়িতে ব্যাগভরা টাকা পাওয়ার রহস্য, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের একসাথে আটক করা ইত্যাদি একের পর এক ঘটনা পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। তাছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা, বস্তিতে আগুন, গার্মেন্টসে হত্যা-হামলা-উস্কানি ইত্যাদিও হঠাত্ বেড়ে গেছে। পথে-ঘাটে, পাড়ায়, হাটে-বাজারে, প্রতিষ্ঠানে—সর্বত্রই নেমে এসেছে তীব্র অস্বস্তি ভাব। সাধারণ মানুষের মেজাজ-মর্জি, উত্তেজনা চড়তে শুরু করেছে। সরকার তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। বিএনপির কায়-কারবারও মানুষ পছন্দ করছে না। সরকার হরতাল ডাকার উপলক্ষ তৈরি করে দিচ্ছে। বিএনপি (সাথে জামায়াত) হরতালের কথা বলে বোমাবাজি করছে, গাড়ি পোড়াচ্ছে, ভাঙচুর করছে, গাড়িতে মানুষ পুড়িয়ে মারছে। হরতালের কারণে এইচএসসি পরীক্ষার ক্ষেত্রে গুরুতর বিশৃংখলা সৃষ্টি হচ্ছে। চারদিকে অস্থিরতা, অরাজকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশবাসী এসবের কোনোকিছুই পছন্দ করছে না। সরকার ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার পথ নিয়েছে। বিপজ্জনক ফ্যাসিস্ট প্রবণতা বাড়ছে। রাজনীতির বাইরের শক্তির হাতে ক্রমেই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে। মানুষ সবকিছুর ওপর ত্যক্ত-বিরক্ত ও হতাশ-ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। রিমোট কন্ট্রোলে যারা পর্দার আড়াল থেকে দেশ চালায়, সেই দেশি-বিদেশি শক্তি ‘চোরকে বলে চুরি করো, আর গৃহস্থকে বলে চোর ধরো’—ধরনের কৌশল নিয়ে পানি ঘোলা করে নিজেদের বিশেষ কোনো অভিসন্ধি কার্যকর করতে নেমেছে বলে মনে করার কারণ আছে।
বাংলাদেশকে ঘিরে এখন চলছে নানা শক্তির ও ঘটনার টানাপোড়েন। প্রথমেই বলতে হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা। গোলাম আজমসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে চার্জ গঠন ও শুনানি শুরু হয়েছে। জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক শক্তি ও তাদের বিদেশি মুরুব্বিরা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমেরিকাও জামায়াতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে চায়। বাংলাদেশকে তারা ‘মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র’ হিসাবে দেখতে চায়। ইসলামিক দুনিয়ায় মার্কিনপন্থি দেশের মডেল রূপে তারা বাংলাদেশকে তুলে ধরতে বিশেষ আগ্রহী। সেজন্য জামায়াতকে সাথে রাখাটা তার জন্য প্রয়োজন। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক দেশগুলোর মনোভাবও তেমনই। পাকিস্তান আগাগোড়াই বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক’ রাষ্ট্ররূপে পুনঃরূপান্তর করতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটি এতোই জনপ্রিয় যে, তা থেকে এমনিতে বের হয়ে আসা মুশকিল। রাজনৈতিক ধারাবাহিকতাকে ছিন্ন করতে পারলেই কেবল তা তারা নিশ্চিত করতে পারবে। এ কারণেই এসব দেশি-বিদেশি শক্তি যে সম্ভব হলে দেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ‘শর্ট-সার্কিট’ করার ষড়যন্ত্র করবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক। তাদের এরূপ মরিয়া প্রচেষ্টা এখন দেশের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ।
প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগর এলাকায় তার স্বার্থ রক্ষা করা হলো বর্তমানে মার্কিনীদের জন্য অগ্রাধিকারমূলক কর্তব্য। সেক্ষেত্রে তার মূল লক্ষ্য হলো ‘চীন ঠেকাও’। সেই স্ট্র্যাটেজির মধ্যে বাংলাদেশকে তার পাওয়া চাই-ই! এছাড়াও তার রয়েছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ আত্মসাত্ করার লালসা। বাংলাদেশের কাছ থেকে তার স্বার্থ আদায় করার সুবিধার্থে মার্কিনীরা চায় যেন সবসময় এদেশে একটি দুর্বল সরকার ক্ষমতায় থাকে। কারণ, সরকার দুর্বল হলে তার কাছ থেকে সহজে অনেক কনসেশন আদায় করা যায়। ভারতের বুর্জোয়া সরকারও তার বাণিজ্যিক ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ আদায় করতে চায়। এই বিবেচনা থেকে তার জন্যও এদেশে সবসময় একটি দুর্বল সরকার ক্ষমতায় থাকাটা সুবিধাজনক। এই স্ট্র্যাটেজি থেকে এসব বিদেশি শক্তি দেশের রাজনীতিকে ‘নিয়ন্ত্রিত নৈরাজ্যের’ (controlled chaos)-এর মধ্যে রাখতে আগ্রহী। এজন্য তারা অন্যান্য পন্থার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ভিত্তি করে ‘ভাগ করো, শাসন করো’—নীতির ধারায় কর্মকৌশল প্রয়োগ করে চলেছে। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে গণচীনেরও বাণিজ্যিক-ব্যবসায়িক ও সেইসাথে নানা ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশের ঘটনাবলির ওপর এসব জটিল ও বহুমুখী শক্তির ও স্বার্থের অভিঘাত এসে আঘাত করছে।
বাংলাদেশকে ভিত্তি করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ডা হয়তো এখন এমন জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, আওয়ামী লীগ-বিএনপির মাধ্যমে তাদের স্বার্থ পুরোপুরি রক্ষা হবে বলে তারা আর মনে করতে পারছে না। নিজেদের খাস লোককে ক্ষমতায় বসানোটা এখন তার জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠে থাকতে পারে। সেজন্যই আবার ওয়ান-ইলেভেনের কথাবার্তা বাতাসে ছড়ানো হয়েছে। তাই হয়তো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবার তার ঢাকা সফরের সময় এই সিগনাল দিয়ে গেলেন যে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুই শক্তিই কেবল তার হাতে আছে এমন নয়। তার হাতে এর বাইরে আরেকটি শক্তি, আরেকটি ‘অপশনও’ আছে। সেটি হলো তথাকথিত ‘সুশীল সমাজ’ ও ‘বিরাজনীতিকীকরণের’ পথ। সেই পথকে অনিবার্য করে তুলতে হলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সংঘাত, সংঘর্ষ, নৈরাজ্য ইত্যাদি বাড়িয়ে তোলা দরকার। সেই পথকে উস্কে দিতে হলে বাইরে শান্তিকামী সেজে ‘সমঝোতার’ শর্ত আরোপ করার পাশাপাশি গোপনে দু’পক্ষকে দিয়ে সংঘাত ও অচলাবস্থা সৃষ্টি করানোটাই হলো চাণক্য বা ম্যাকিয়াভেলিয়ান কূটকৌশল। তেমনই কি ঘটে চলেছে? কে বলতে পারে সে কথা। তবে এই দ্রুত উত্তপ্ত ও সংঘাতময় হয়ে ওঠা পরিস্থিতির জন্য দেশের বড় দুটি বুর্জোয়া দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিই প্রধানত দায়ী। তাদের দায়িত্বহীন, বেপরোয়া, আত্মঘাতী পদক্ষেপই পরিস্থিতিকে অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতায় ডুবিয়ে দিচ্ছে। তাদের নেতা-কর্মীদের অধিকাংশের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা হলো ‘টু পাইস’ কামিয়ে নিয়ে নিজ-নিজ ব্যক্তিগত আখের গুছানোর একটি উপায় মাত্র। যারা ক্ষমতায় আছে তারা লুটপাটের সুযোগ অব্যাহত রাখার জন্য ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া। তেমনি আবার যারা ক্ষমতার বাইরে আছে তারা লুটপাটের সুযোগের জন্য ক্ষমতায় ফিরে যেতে মরিয়া। লুটপাটের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রক্ষমতা আর সেই ক্ষমতার লোভে তারা আজ অন্ধ-উন্মাদের মতো সংঘাতে লিপ্ত। এজন্য ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ’ করতেও তারা পিছপা হবে না। তাদের এহেন আচরণ ও কাজের ফলেই বিদেশিরা নাক গলানোর সুযোগ পেয়েছে।
শরত্বাবুর ‘পরিণীতার’ গুরুচরণ তার পঞ্চম কন্যা সন্তানের জন্মসংবাদ জানতে পেরে দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে একথা কি অস্বীকার করার উপায় আছে যে, তিনি নিজেই হচ্ছেন এই দুশ্চিন্তার কারণের জন্মদাতা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সত্য হলো সেরূপই।
[লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি]